Friday, January 27, 2017

অজানা


ট্রেনটা সশব্দে লাকসাম স্টেশনে এসে থামল। যাত্রীরা সব একের পর এক হুড়মুড় করে নামতে লাগল। প্রাপ্তিও বাবার হাত ধরে নেমে গেল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে প্রাপ্তির। বাবারও একই অবস্থা। বাবা প্রাপ্তিকে স্টেশনের যাত্রীছাউনিতে বসিয়ে ট্যাক্সির সন্ধানে বেরিয়ে গেল।
প্রাপ্তিদের গ্রামের বাড়ি স্টেশন থেকে বেশ দূরে। ট্যাক্সিতে যেতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা তো লাগেই। ওরা চট্টগ্রামে থাকে। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছে প্রাপ্তি আর বাবা।
একটু পর বাবা হতাশমুখে ফিরে এলেন। যা ভেবেছিল তাই, বাবা ট্যাক্সি পায়নি। এই সন্ধ্যায় ট্যাক্সি না পেলে কীভাবে যাবে ওরা? অনুষ্ঠান অবশ্য কাল।
‘প্রাপ্তি, চল্ আগে একটা হোটেল থেকে ভাত খেয়ে আসি। কী বলিস?’ বাবার কথায় প্রাপ্তিও রাজি হয়ে গেল। খিদেয় পেট জ্বলছে। অর্ডার দেওয়ামাত্রই খাবার চলে এল। দেরি না করে প্রাপ্তি আর বাবা গপাগপ খেয়ে ফেলল। বিল দিয়ে বেরিয়ে এসে বাবা আবার ট্যাক্সি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কেউই যেতে চায় না। শেষমেশ দ্বিগুণ ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সিতে উঠে বাবা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ‘যাক্, পাওয়া গেল ট্যাক্সিটা। না হলে যে আজ কী হতো!’
ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঠাস করে একটা শব্দ হলো। প্রাপ্তি চমকে উঠল। কী হলো? ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘ভাই, আর যাওন যাইব না। টায়ার ফাইট্টা গেছে। আপনারা নাইম্মা যান।’
অবস্থা দেখে দুজন নেমে গেল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি মেরামত করার চেষ্টা করতে লাগল। প্রাপ্তি আর বাবাও হাঁটা শুরু করল। জায়গাটা নির্জন। পথে কোনো গাড়িও নেই। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সামনে একটা হোটেল দেখতে পেল। হোটেলের দোতলা ভবনটা বেশ পুরোনো। নামটা জ্বলজ্বল করছে আলোয়, ‘কুমুদিনী হোটেল’।
ভেতরে ঢুকে ওরা দেখল, ভেতরের অবস্থা বাইরের থেকে ভালো। তবে কেমন যেন পরিবেশটা। এখানে রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। ভোরে বেরিয়ে পড়তে হবে। দোতলার একটা ঘর ভাড়া নিল প্রাপ্তিরা। প্রাপ্তি বাবার কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেল। বাবাও পেছন পেছন আসতে লাগল।
প্রাপ্তি দোতলায় উঠে ওদের ঘরটা দেখে নিল। বেশ পরিচ্ছন্ন। দুটো বিছানা পাশাপাশি। জুতা খুলে একটা বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই এতক্ষণ ঝিম ধরে থাকা ঘুম জাপটে ধরল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রাপ্তি।
হঠাৎ কথা বলার শব্দে ঘুম ভাঙল ওর। চোখ খুলে দেখল অনেক মানুষ আশপাশে দাঁড়িয়ে আছে। বাবার কোলে তার মাথাটা রাখা। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে তাকিয়ে চেনা গেল না জায়গাটা। কাল রাতের হোটেলটা তো নয়। এটা কোন জায়গা?
‘তুই স্টেশন থেকে কাল কোথায় গিয়েছিলি?’ বাবার প্রশ্নে অবাক হয়ে শোয়া থেকে ধরমড় করে উঠে বসল প্রাপ্তি। ‘তুমিই না আমাকে কাল স্টেশন থেকে নিয়ে গেলে? তারপর আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। আমরা কুমুদিনী হোটেলে গেলাম।’
শুনে পাশ থেকে একজন বললেন, ‘যা ভেবেছিলাম। এটা সেই অভিশপ্ত হোটেলের কেস।’ প্রাপ্তি এতক্ষণ খেয়াল করেনি, পাশে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশটা বললেন, ‘ভাই, আমরা এটার ব্যাপারে গত দুই বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো সমাধান পাইনি। এখন আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত।’
‘আমি পুরো ব্যাপারটা শুনতে চাই। আমাকে কি আপনারা একটু বলবেন, কী ঘটেছিল?’ বাবা সবার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। একজন বলতে শুরু করলেন, ‘আজ থেকে পাঁচ বছর আগে কুমুদিনী হোটেল নামে একটা হোটেল ছিল। সেখানে এক রাতে এক নিষ্ঠুর বাবা নিজ হাতে তার মেয়েকে খুন করেন। পরে নিজেও আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে ওই হোটেল পুলিশি ঝামেলায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে লোকমুখে প্রচলিত আছে, এখানে প্রতিবছর খুনের দিনটায় সেই হোটেলটা জেগে ওঠে। গত বছর এই সময়ে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া গিয়েছিল। আপনার সৌভাগ্য যে মেয়েটা বেঁচে গেছে।’
বাবা অবিশ্বাস ভরা চোখ নিয়ে তাকাল প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি রাতের সব ঘটনা এক এক করে খুলে বলল। সব শুনে এক লোক বললেন, ‘হ্যাঁ, হোটেলটার যে রকম বর্ণনা দিয়েছে ও, তেমনই ছিল। হোটেলের জীর্ণ বিল্ডিংটা এখনো আছে। আর ওকে বিল্ডিংয়ের ভেতরেই পাওয়া গিয়েছিল জ্ঞানহীন অবস্থায়।’
বাবা এরপর আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে থানা থেকে প্রাপ্তিকে নিয়ে বেরিয়ে এল। সেবার আর তাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি। চট্টগ্রামে আবার ফিরে এসেছিল ওরা। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ভয়, আতঙ্ক আর অবিশ্বাস মেশানো এক অভিজ্ঞতা।
আজ প্রায় এক বছর কেটে গেছে। কিন্তু প্রাপ্তির মন থেকে একটা প্রশ্ন আজও দূর হয়নি। আচ্ছা, স্টেশন থেকে ও হোটেলে গিয়েছিল কার সঙ্গে?


সপ্তম শ্রেণি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
সুত্র প্রথম আলো

0 comments:

Post a Comment