skip to main |
skip to sidebar
পদ্মপরি ভর করেছে আমার নাতনির মাথায়—পদ্মপরি তাকে ছাড়ছে না কিছুতেই। দোষটা
অবশ্য ষোলো আনাই আমার। রোজ রাতে তাকে পদ্মপরির গল্প শোনাই,
আলতাপরি-সমুদ্রপরি-মেঘপরিসহ কত-না রূপকথার গল্প আমি শোনাই তাকে! ও গল্প
শুনতে খুব ভালোবাসে। আমার ঝুলিতে আর কত গল্প জমা আছে! তাই, গল্প শোনাই ওকে
বানিয়ে বানিয়ে। ওর দাদির ঝুলি সেই কবে শেষ।
বানানো গল্পের ভেতর ওর
সবচেয়ে বেশি পছন্দ পদ্মপরির গল্প। পরিটা আমার নাতনিরই বয়সী। তার শরীরের রং
পদ্মপাপড়ির মতো গোলাপি, মাথার চুলগুলো সোনালি, বড় বড় হরিণচোখের রং আকাশের
মতো নীল, খিলখিল করে হাসে যখন সে, তখন মুক্তোর মতো দাঁতগুলো থেকে যেন আলো
ছিটকে বেরোয়, সারা শরীরে তার পদ্মফুলের গন্ধ মাখানো। চমৎকার দুই খানা পাখা
আছে তার, পাখার রং জামদানি শাড়ির কারুকাজ করা পাড়ের মতো সুন্দর। জামদানি
শাড়ি তো নাতনির মায়ের আছে দুজোড়া। পদ্মপরির ডানা থেকে রং এনে বানানো হয়েছে
শাড়িগুলোর পাড়—এ রকম বিশ্বাস আমার নাতনির। গত এক বছরে পদ্মপরির যতগুলো গল্প
আমি শুনিয়েছি ওকে, তা লিখে রাখলে একখানা মোটাসোটা পরিকাব্য বা পরিকাহিনি
নামক বই হয়ে যেত।
পদ্মপরিটা থাকে চাঁদে। ওখানেই ওদের সোনার রাজপ্রাসাদ।
সেই প্রাসাদের সিঁড়িগুলো মুক্তো দিয়ে বানানো, তার ওপরে হীরার কারুকাজ।
প্রতি পূর্ণিমা রাতে পরিটা আকাশ থেকে নেমে আসে আমাদের বাড়ির পাশের হাওরের
পদ্মবনে। বিশাল পিতলের থালার মতো বড় বড় পদ্মপাতার মঞ্চে সে খুশিতে নাচে।
পদ্মফুলের পাপড়িতে হেঁটে বেড়ায়। হাওরের টলটলে জল ছুঁয়ে মনের আনন্দে ওড়ে,
ঘুরে বেড়ায়।
আমার নাতনিটার নাম সীমা। ওর দাদি ডাকেন সোনামণি। আমি ডাকি
পরি বলে। স্কুলে যাওয়ার বয়স এখনো ওর হয়নি। সবে চার বছর পেরিয়েছে। ওর সবচেয়ে
বড় বন্ধু আমি। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়ে, চট্টগ্রাম
থেকে গ্রামে চলে এসেছি। পরির বাবা—আমার বড় ছেলে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার।
গ্রামেই থাকে সে। আমি আর পরির দাদি বাড়িতে আসার পরে পরির যেন সত্যিই
পদ্মপরির মতো সোনালি পাখা গজিয়েছে। রাতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে ও
দাদা-দাদির মাঝখানে।
প্রায় ৪০ বছর থেকেছি দেশের নানা শহরে। তাই গ্রামে
আমার বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। দক্ষিণ পাড়ার হাওরপাড়ের হাশেম আলী, এখন যে
একনামে পরিচিত ‘পুতুল বুড়ো’ নামে, সে আর আমি একসঙ্গে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত
পড়েছিলাম। বাল্যবন্ধু। এখন আমার অঢেল সময়। বিকেল বা সন্ধ্যায় তার বাড়িতে
যাই। গল্পগুজবে সময় ভালোই কাটে। আমি চাকরি থেকে অবসর নিলেও হাশেম কিন্তু
তার পেশা ছাড়েনি। সে সিক্স পর্যন্ত পড়ার পর তার বাবার সঙ্গে দূর-দূরান্তের
মেলায় যেত ‘পুতুলনাচ’ দেখাতে। বানাত সুন্দর সুন্দর কাপড়ের পুতুল। তার তৈরি
পুতুলের অনেক চাহিদা। পাইকারেরা এখন তার বাড়িতে এসে নানান নামের, নানান
পুতুল নিয়ে খুলনা-ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠান। আমিও গেল এক বছরে হাশেমের কাছ থেকে
অনেক পুতুল এনে দিয়েছি পরিকে। বাড়ির একটা রুম এখন ওই পুতুলগুলোর দখলে।
ওটাই ওর খেলাঘর-পুতুলঘর।
আজ সন্ধ্যার পরে পরি আমাদের রুমে এসে বড় বড় চোখে বলল, ‘দাদা! কালকে কিন্তু পূর্ণিমা! আমি কিন্তু কাল রাতে পদ্মপরিকে দেখতে যাবই যাব!’
না,
পদ্মপরি তো কোনো কিছুতেই নামছে না পরির ঘাড়-মাথা থেকে! হাওরে এখন পানি
বেশি। পদ্মফুলও সব দুর্গাপুজোর সময় চালান হয়ে গেছে খুলনা-ঢাকায়। পুজোর পাঁচ
দিনের প্রতিদিনই ১০৮টি করে পদ্মফুল লাগে। তা ছাড়া, হাওরে আছে মাথাকাটা
দৈত্য। হিজল-করমচাগাছে থাকে জিন-পরিরা। কিন্তু কিসের কী! প্রতিবারই বলে,
‘তুমি আছ না? তুমিই না কত দৈত্য-দানব-জিন-ভূতকে পা ধরে বোঁ বোঁ করে
ঘুরিয়েছ?’
নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই আটকা পড়া বলে একে।
‘ও দাদা, কাল সন্ধ্যায় হাওরে নিয়ে যাবে তো? পদ্মপরিকে দেখার খুব শখ আমার।’
এ
সময়ে নামাজ শেষ করে ওর দাদি ওকে উসকে দিলেন, ‘সোনামণিরে! তোর দাদা ইচ্ছে
করলে পদ্মপরিটাকে ধরে এনে খাঁচায় পুরে পুষতেও পারে। তুই রোজ ওকে পদ্মটুনা
খাওয়াবি, গরু-ছাগলের দুধ খাওয়াবি, পোষ মেনে গেলে পরিটা তোর বান্ধবী হয়ে
যাবে। আমাদের মাঝখানে ঘুমোবি তোরা দুজনে।’
একেই বলে কারেন্ট জালে আটকা
পড়া! অনেক কথার পরে পরিকে বললাম, ‘যাব আমরা পদ্মমহালে। তবে পদ্মপরি এখনো
ছোট তো! এখন এনে পোষা যাবে না। বড় হলে ধরে আনব।’
আমার পরি যা একখানা হাসি এবার দিল না!
হাওরের
পূর্ব প্রান্তে বুদ্ধপূর্ণিমার গোলগাল চাঁদ। তালের ডোঙায় চড়েছি আমি আর
পরি। পদ্মমহালে এসে পড়লাম আমরা। শত শত পদ্মফুল ফুটে আছে—রাতেই ফোটে পদ্মরা।
দিনে ঘুমায়।
ডোঙা ঢুকিয়ে দিলাম পদ্মবনের ভেতরে। একটি পদ্মপিপি পাখি ভয়
পেয়ে উড়ে পালাল ডাকতে ডাকতে। আরেকটু এগিয়ে আমরা হিজলগাছটার কাছে থামলাম,
হাত বাড়ালাম হাত দশেক সামনের পদ্মপাতার মঞ্চটার দিকে। পরি সঙ্গে সঙ্গে
দেখতে পেল পদ্মপরিটাকে, মঞ্চের ওপরে চিত হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদটার দিকে।
আমার কোলে বসা পরি ভয় ও উত্তেজনায় কাঁপছে। ও মা! পদ্মপরিটা উঠে বসল, পাতার
মঞ্চে নাচল কয়েক পাক। শোনা গেল ঘুঙুরের আওয়াজ। তারপরে একটা ফুলের পাপড়িতে
দাঁড়িয়ে নাচল আরও কয়েক পাক। তারপরে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে সোনালি ডানায় উড়ল
কিছুক্ষণ। তারপরে আবার সেই পাতার মঞ্চটায় এসে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে।
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘পরি! ও এখন ঘুমোবে। চল, আমরা ফিরে যাই!’
পরি রাজি হলো। আমি ডোঙার মুখ ঘুরিয়ে রওনা দিলাম।
কেউ হাসে হা-হা আর কেউ হাসে হি-হি
কারও হাসি খসখসে কারও খুব মিহি
কেউ হাসে হে-হে আর কেউ হাসে হো-হো
কেউ খুব ছটফটে কেউ নির্মোহ
কেউ হাসে হি-হি আর কেউ হাসে হু-হু
হেসে হেসে চাকু মেরে বলে আহা উহু
কেউ হাসে হো-হো আর কেউ হাসে হা-হা
তুলনাবিহীন হাসি বলব কী আহা
কেউ হাসে ঠোঁটে-মুখে কেউ চোখে-চোখে
হৃদয়টা ফালা-ফালা কে-বা তাকে রোখে
কেউ হাসে চেপে চেপে কেউ মিটিমিটি
কেউ হাসে কুটুকুটু কেউ কিটিকিটি
অট্টহাসিতে কারও, কেঁপে ওঠে ছাদ
কারও হাসি ঠোঁটে যেন গলে পড়া চাঁদ
হাসতে হাসতে কেউ ঢলে পড়ে কোলে
তাক ধিনা ধিন ধিনা তবলার বোলে
কারও হাসি ফিকফিক কারও খিকখিক
উল্টাপাল্টা হাসে কেউ ঠিকঠিক
কেউ হাসে তালা মেরে কেউ দিল খুলে
কেউ হাসে হাত নেড়ে কেউ দু পা তুলে
নীরবে গোপনে কেউ হাসে একা একা
পর্দার আড়ালে তা যায় না তো দেখা
হাসতে হাসতে কারও চোখে আসে পানি
বোকা-বোকা হাসে কেউ একেবারে ফানি
কৌতুক শোনা-হাসি পেটে ধরে খিল
হাসির সঙ্গে হাসি নেই কোনো মিল
হিটলারি হাসি কারও মোনালিসা হাসি
কারও হাসি মনে হয় অবিকল কাশি
কাকে বলে হাসি আর ক প্রকার কী কী
গবেষণা করে বের করবই ঠিক-ই
কাঁদতে চাই না কেউ হাসি ভালোবাসি
হাসি নিয়ে চলো শুধু করি হাসাহাসি।
prothom-alo
অনেক অনেক কাল আগের কথা। এক দেশে হঠাৎ করে এক আজব ভূতের আগমন ঘটে। সেই
ভূত রাতের বেলা মানুষের ঘুমানোর সময় কাছে গিয়ে একটা মন্ত্র পড়ত। মন্ত্র
পড়ার পরে সে গায়েব হয়ে যেত। আর মানুষ কাশতে শুরু করত। এইভাবে সে মানুষের
ঘুম তাড়িয়ে দিত। সারা দিন কাজ করে বেচারা মানুষদের কেবল যখন ঘুম পেয়েছে,
তখনই তারা কাশতে শুরু করত। দিনভর কাজকর্ম করে ঘরে ফিরে যদি রাতে না ঘুমানো
যায়, তাহলে কি আর মন ঠিক থাকে?
সেই দেশের রাজা কত ওঝাকেই না ডাকলেন,
কিন্তু ওঝারা শত চেষ্টায়ও কিছুই করতে পারল না। শেষে খবর এল, এক দেশে এক ভূত
আছে, যে মানুষের কাশি দূর করে দেয়। রাজা তখন তাকেই ডাকলেন সাহায্যের জন্য।
সে বিনা দ্বিধায় রাজি হয়ে গেল।
সে ছিল ভূতদের মধ্যে সবচেয়ে বড় যোদ্ধা। তো সে রাতের বেলা ঘুম তাড়ানো ভূতটির আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, লুকিয়ে অদৃশ্য হয়ে।
একসময়
ঘুম তাড়ানো ভূতটি এল। যোদ্ধা ভূতটাও অন্য একটি মন্ত্র বলার জন্য প্রস্তুত
হয়ে গেল। ঘুম তাড়ানো ভূত ও যোদ্ধা ভূত একসঙ্গে মন্ত্র শুরু করল এবং একসঙ্গে
শেষ করল।
ঘুম তাড়ানো ভূতের অনেকক্ষণ ধরে মনে হচ্ছিল, কেউ এখানে আছে।
তাই সে মন্ত্র বলা শেষ হওয়ার পরেও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল কাশির শব্দ শোনার
জন্য।
যখন
সে একটুও কাশির আওয়াজ শুনতে পেল না, তখন অবাক হলো। তার মনে ভয় ঢুকে গেল।
ঠিক তখনই যোদ্ধা ভূত তার সামনে এল। ঘুম তাড়ানো ভূতটি যোদ্ধা ভূতকে দেখে গেল
ভড়কে। সে আমতা-আমতা করে কোনোমতে বলল, ‘আপনি এখানে কী করছেন?’
‘তোকে মারতে এসেছি।’ হুংকার দিয়ে উঠল যোদ্ধা ভূত।
সঙ্গে
সঙ্গে সে নিজের তির বের করে ধনুকের মধ্যে ঢুকিয়ে দিল এবং তির নিক্ষেপ করল।
এই তির বিদ্ধ হয়ে ঘুম তাড়ানো ভূত বিকট শব্দে আর্তনাদ করে উঠল।
আশপাশের
লোকজন সবাই ছুটে এল। তাদের কাশি থেমে গেছে। তাদের সঙ্গে রাজাও এলেন। রাজা
বললেন, ‘তুমি আমার প্রজাদের জন্য যা করেছ, তা আমি কখনো ভুলব না। আমি তোমাকে
আমার রিজার্ভ ফোর্সের সেনাপতি হিসেবে ঘোষণা করলাম। দেশে যখন কোনো দুর্যোগ
হবে, তখন তোমাকে এগিয়ে আসতে হবে।’ যোদ্ধা ভূত রাজার কথায় সম্মতি জানাল।
সেই
থেকে প্রজারা আবার সুখে শান্তিতে ঘুমাতে পারল। আর যোদ্ধা ভূত মহা সুখে সেই
দেশে বাস করতে থাকল। আর অপেক্ষা করতে লাগল দেশের কোনো দুর্যোগে এগিয়ে
যাওয়ার জন্য।
তৃতীয় শ্রেণি, মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
সুত্র প্রথম আলো
ট্রেনটা সশব্দে লাকসাম স্টেশনে এসে থামল। যাত্রীরা সব একের পর এক হুড়মুড়
করে নামতে লাগল। প্রাপ্তিও বাবার হাত ধরে নেমে গেল। প্রচণ্ড খিদে পেয়েছে প্রাপ্তির। বাবারও একই অবস্থা। বাবা প্রাপ্তিকে স্টেশনের যাত্রীছাউনিতে বসিয়ে ট্যাক্সির সন্ধানে বেরিয়ে গেল।
প্রাপ্তিদের
গ্রামের বাড়ি স্টেশন থেকে বেশ দূরে। ট্যাক্সিতে যেতে কমপক্ষে এক ঘণ্টা তো
লাগেই। ওরা চট্টগ্রামে থাকে। বাড়িতে একটা অনুষ্ঠান উপলক্ষে এসেছে প্রাপ্তি
আর বাবা।
একটু পর বাবা হতাশমুখে ফিরে এলেন। যা ভেবেছিল তাই, বাবা
ট্যাক্সি পায়নি। এই সন্ধ্যায় ট্যাক্সি না পেলে কীভাবে যাবে ওরা? অনুষ্ঠান
অবশ্য কাল।
‘প্রাপ্তি, চল্ আগে একটা হোটেল থেকে ভাত খেয়ে আসি। কী বলিস?’
বাবার কথায় প্রাপ্তিও রাজি হয়ে গেল। খিদেয় পেট জ্বলছে। অর্ডার দেওয়ামাত্রই
খাবার চলে এল। দেরি না করে প্রাপ্তি আর বাবা গপাগপ খেয়ে ফেলল। বিল দিয়ে
বেরিয়ে এসে বাবা আবার ট্যাক্সি খুঁজতে লাগল। কিন্তু কেউই যেতে চায় না।
শেষমেশ দ্বিগুণ ভাড়ায় একটা ট্যাক্সি পাওয়া গেল। ট্যাক্সিতে উঠে বাবা
স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। ‘যাক্, পাওয়া গেল ট্যাক্সিটা। না হলে যে আজ কী
হতো!’
ট্যাক্সি চলতে শুরু করল। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ ঠাস করে একটা শব্দ হলো।
প্রাপ্তি চমকে উঠল। কী হলো? ট্যাক্সিওয়ালা বলল, ‘ভাই, আর যাওন যাইব না।
টায়ার ফাইট্টা গেছে। আপনারা নাইম্মা যান।’
অবস্থা
দেখে দুজন নেমে গেল। ট্যাক্সি ড্রাইভার ট্যাক্সি মেরামত করার চেষ্টা করতে
লাগল। প্রাপ্তি আর বাবাও হাঁটা শুরু করল। জায়গাটা নির্জন। পথে কোনো গাড়িও
নেই। হাঁটতে হাঁটতে ওরা সামনে একটা হোটেল দেখতে পেল। হোটেলের দোতলা ভবনটা
বেশ পুরোনো। নামটা জ্বলজ্বল করছে আলোয়, ‘কুমুদিনী হোটেল’।
ভেতরে ঢুকে
ওরা দেখল, ভেতরের অবস্থা বাইরের থেকে ভালো। তবে কেমন যেন পরিবেশটা। এখানে
রাতটা কাটিয়ে দিতে পারলেই হলো। ভোরে বেরিয়ে পড়তে হবে। দোতলার একটা ঘর ভাড়া
নিল প্রাপ্তিরা। প্রাপ্তি বাবার কাছ থেকে চাবিটা নিয়ে দৌড়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে
গেল। বাবাও পেছন পেছন আসতে লাগল।
প্রাপ্তি দোতলায় উঠে ওদের ঘরটা দেখে
নিল। বেশ পরিচ্ছন্ন। দুটো বিছানা পাশাপাশি। জুতা খুলে একটা বিছানায় গা
এলিয়ে দিতেই এতক্ষণ ঝিম ধরে থাকা ঘুম জাপটে ধরল। ঘুমিয়ে পড়ল প্রাপ্তি।
হঠাৎ
কথা বলার শব্দে ঘুম ভাঙল ওর। চোখ খুলে দেখল অনেক মানুষ আশপাশে দাঁড়িয়ে
আছে। বাবার কোলে তার মাথাটা রাখা। বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চারপাশে
তাকিয়ে চেনা গেল না জায়গাটা। কাল রাতের হোটেলটা তো নয়। এটা কোন জায়গা?
‘তুই
স্টেশন থেকে কাল কোথায় গিয়েছিলি?’ বাবার প্রশ্নে অবাক হয়ে শোয়া থেকে ধরমড়
করে উঠে বসল প্রাপ্তি। ‘তুমিই না আমাকে কাল স্টেশন থেকে নিয়ে গেলে? তারপর
আমাদের গাড়ি নষ্ট হয়ে গেল। আমরা কুমুদিনী হোটেলে গেলাম।’
শুনে পাশ থেকে
একজন বললেন, ‘যা ভেবেছিলাম। এটা সেই অভিশপ্ত হোটেলের কেস।’ প্রাপ্তি এতক্ষণ
খেয়াল করেনি, পাশে একজন পুলিশ দাঁড়িয়ে আছেন। পুলিশটা বললেন, ‘ভাই, আমরা
এটার ব্যাপারে গত দুই বছর ধরে অনুসন্ধান চালিয়ে যাচ্ছি। কোনো সমাধান পাইনি।
এখন আমরাও বিশ্বাস করতে শুরু করেছি, ব্যাপারটা অতিপ্রাকৃত।’
‘আমি পুরো
ব্যাপারটা শুনতে চাই। আমাকে কি আপনারা একটু বলবেন, কী ঘটেছিল?’ বাবা সবার
দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল। একজন বলতে শুরু করলেন, ‘আজ থেকে পাঁচ বছর আগে
কুমুদিনী হোটেল নামে একটা হোটেল ছিল। সেখানে এক রাতে এক নিষ্ঠুর বাবা নিজ
হাতে তার মেয়েকে খুন করেন। পরে নিজেও আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে ওই হোটেল
পুলিশি ঝামেলায় বন্ধ হয়ে যায়। তবে লোকমুখে প্রচলিত আছে, এখানে প্রতিবছর
খুনের দিনটায় সেই হোটেলটা জেগে ওঠে। গত বছর এই সময়ে একটা মেয়ের লাশ পাওয়া
গিয়েছিল। আপনার সৌভাগ্য যে মেয়েটা বেঁচে গেছে।’
বাবা অবিশ্বাস ভরা চোখ
নিয়ে তাকাল প্রাপ্তির দিকে। প্রাপ্তি রাতের সব ঘটনা এক এক করে খুলে বলল। সব
শুনে এক লোক বললেন, ‘হ্যাঁ, হোটেলটার যে রকম বর্ণনা দিয়েছে ও, তেমনই ছিল।
হোটেলের জীর্ণ বিল্ডিংটা এখনো আছে। আর ওকে বিল্ডিংয়ের ভেতরেই পাওয়া গিয়েছিল
জ্ঞানহীন অবস্থায়।’
বাবা এরপর আর কথা না বাড়িয়ে সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে
থানা থেকে প্রাপ্তিকে নিয়ে বেরিয়ে এল। সেবার আর তাদের বাড়ি যাওয়া হয়নি।
চট্টগ্রামে আবার ফিরে এসেছিল ওরা। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল ভয়, আতঙ্ক আর
অবিশ্বাস মেশানো এক অভিজ্ঞতা।
আজ প্রায় এক বছর কেটে গেছে। কিন্তু প্রাপ্তির মন থেকে একটা প্রশ্ন আজও দূর হয়নি। আচ্ছা, স্টেশন থেকে ও হোটেলে গিয়েছিল কার সঙ্গে?
সপ্তম শ্রেণি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বালিকা উচ্চবিদ্যালয় ও কলেজ
সুত্র প্রথম আলো