Saturday, January 28, 2017

পদ্মপরি

 
kidszonebd

পদ্মপরি ভর করেছে আমার নাতনির মাথায়—পদ্মপরি তাকে ছাড়ছে না কিছুতেই। দোষটা অবশ্য ষোলো আনাই আমার। রোজ রাতে তাকে পদ্মপরির গল্প শোনাই, আলতাপরি-সমুদ্রপরি-মেঘপরিসহ কত-না রূপকথার গল্প আমি শোনাই তাকে! ও গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। আমার ঝুলিতে আর কত গল্প জমা আছে! তাই, গল্প শোনাই ওকে বানিয়ে বানিয়ে। ওর দাদির ঝুলি সেই কবে শেষ।
বানানো গল্পের ভেতর ওর সবচেয়ে বেশি পছন্দ পদ্মপরির গল্প। পরিটা আমার নাতনিরই বয়সী। তার শরীরের রং পদ্মপাপড়ির মতো গোলাপি, মাথার চুলগুলো সোনালি, বড় বড় হরিণচোখের রং আকাশের মতো নীল, খিলখিল করে হাসে যখন সে, তখন মুক্তোর মতো দাঁতগুলো থেকে যেন আলো ছিটকে বেরোয়, সারা শরীরে তার পদ্মফুলের গন্ধ মাখানো। চমৎকার দুই খানা পাখা আছে তার, পাখার রং জামদানি শাড়ির কারুকাজ করা পাড়ের মতো সুন্দর। জামদানি শাড়ি তো নাতনির মায়ের আছে দুজোড়া। পদ্মপরির ডানা থেকে রং এনে বানানো হয়েছে শাড়িগুলোর পাড়—এ রকম বিশ্বাস আমার নাতনির। গত এক বছরে পদ্মপরির যতগুলো গল্প আমি শুনিয়েছি ওকে, তা লিখে রাখলে একখানা মোটাসোটা পরিকাব্য বা পরিকাহিনি নামক বই হয়ে যেত।
পদ্মপরিটা থাকে চাঁদে। ওখানেই ওদের সোনার রাজপ্রাসাদ। সেই প্রাসাদের সিঁড়িগুলো মুক্তো দিয়ে বানানো, তার ওপরে হীরার কারুকাজ। প্রতি পূর্ণিমা রাতে পরিটা আকাশ থেকে নেমে আসে আমাদের বাড়ির পাশের হাওরের পদ্মবনে। বিশাল পিতলের থালার মতো বড় বড় পদ্মপাতার মঞ্চে সে খুশিতে নাচে। পদ্মফুলের পাপড়িতে হেঁটে বেড়ায়। হাওরের টলটলে জল ছুঁয়ে মনের আনন্দে ওড়ে, ঘুরে বেড়ায়।
আমার নাতনিটার নাম সীমা। ওর দাদি ডাকেন সোনামণি। আমি ডাকি পরি বলে। স্কুলে যাওয়ার বয়স এখনো ওর হয়নি। সবে চার বছর পেরিয়েছে। ওর সবচেয়ে বড় বন্ধু আমি। আমার ক্ষেত্রেও তা-ই। চাকরিজীবন থেকে অবসর নিয়ে, চট্টগ্রাম থেকে গ্রামে চলে এসেছি। পরির বাবা—আমার বড় ছেলে প্রাইমারি স্কুলের মাস্টার। গ্রামেই থাকে সে। আমি আর পরির দাদি বাড়িতে আসার পরে পরির যেন সত্যিই পদ্মপরির মতো সোনালি পাখা গজিয়েছে। রাতে গল্প শুনতে শুনতে ঘুমাবে ও দাদা-দাদির মাঝখানে।
প্রায় ৪০ বছর থেকেছি দেশের নানা শহরে। তাই গ্রামে আমার বন্ধুবান্ধব তেমন নেই। দক্ষিণ পাড়ার হাওরপাড়ের হাশেম আলী, এখন যে একনামে পরিচিত ‘পুতুল বুড়ো’ নামে, সে আর আমি একসঙ্গে ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়েছিলাম। বাল্যবন্ধু। এখন আমার অঢেল সময়। বিকেল বা সন্ধ্যায় তার বাড়িতে যাই। গল্পগুজবে সময় ভালোই কাটে। আমি চাকরি থেকে অবসর নিলেও হাশেম কিন্তু তার পেশা ছাড়েনি। সে সিক্স পর্যন্ত পড়ার পর তার বাবার সঙ্গে দূর-দূরান্তের মেলায় যেত ‘পুতুলনাচ’ দেখাতে। বানাত সুন্দর সুন্দর কাপড়ের পুতুল। তার তৈরি পুতুলের অনেক চাহিদা। পাইকারেরা এখন তার বাড়িতে এসে নানান নামের, নানান পুতুল নিয়ে খুলনা-ঢাকা-চট্টগ্রাম পাঠান। আমিও গেল এক বছরে হাশেমের কাছ থেকে অনেক পুতুল এনে দিয়েছি পরিকে। বাড়ির একটা রুম এখন ওই পুতুলগুলোর দখলে। ওটাই ওর খেলাঘর-পুতুলঘর।
আজ সন্ধ্যার পরে পরি আমাদের রুমে এসে বড় বড় চোখে বলল, ‘দাদা! কালকে কিন্তু পূর্ণিমা! আমি কিন্তু কাল রাতে পদ্মপরিকে দেখতে যাবই যাব!’
না, পদ্মপরি তো কোনো কিছুতেই নামছে না পরির ঘাড়-মাথা থেকে! হাওরে এখন পানি বেশি। পদ্মফুলও সব দুর্গাপুজোর সময় চালান হয়ে গেছে খুলনা-ঢাকায়। পুজোর পাঁচ দিনের প্রতিদিনই ১০৮টি করে পদ্মফুল লাগে। তা ছাড়া, হাওরে আছে মাথাকাটা দৈত্য। হিজল-করমচাগাছে থাকে জিন-পরিরা। কিন্তু কিসের কী! প্রতিবারই বলে, ‘তুমি আছ না? তুমিই না কত দৈত্য-দানব-জিন-ভূতকে পা ধরে বোঁ বোঁ করে ঘুরিয়েছ?’
নিজের পাতা ফাঁদে নিজেই আটকা পড়া বলে একে।
‘ও দাদা, কাল সন্ধ্যায় হাওরে নিয়ে যাবে তো? পদ্মপরিকে দেখার খুব শখ আমার।’
এ সময়ে নামাজ শেষ করে ওর দাদি ওকে উসকে দিলেন, ‘সোনামণিরে! তোর দাদা ইচ্ছে করলে পদ্মপরিটাকে ধরে এনে খাঁচায় পুরে পুষতেও পারে। তুই রোজ ওকে পদ্মটুনা খাওয়াবি, গরু-ছাগলের দুধ খাওয়াবি, পোষ মেনে গেলে পরিটা তোর বান্ধবী হয়ে যাবে। আমাদের মাঝখানে ঘুমোবি তোরা দুজনে।’
একেই বলে কারেন্ট জালে আটকা পড়া! অনেক কথার পরে পরিকে বললাম, ‘যাব আমরা পদ্মমহালে। তবে পদ্মপরি এখনো ছোট তো! এখন এনে পোষা যাবে না। বড় হলে ধরে আনব।’
আমার পরি যা একখানা হাসি এবার দিল না!
হাওরের পূর্ব প্রান্তে বুদ্ধপূর্ণিমার গোলগাল চাঁদ। তালের ডোঙায় চড়েছি আমি আর পরি। পদ্মমহালে এসে পড়লাম আমরা। শত শত পদ্মফুল ফুটে আছে—রাতেই ফোটে পদ্মরা। দিনে ঘুমায়।
ডোঙা ঢুকিয়ে দিলাম পদ্মবনের ভেতরে। একটি পদ্মপিপি পাখি ভয় পেয়ে উড়ে পালাল ডাকতে ডাকতে। আরেকটু এগিয়ে আমরা হিজলগাছটার কাছে থামলাম, হাত বাড়ালাম হাত দশেক সামনের পদ্মপাতার মঞ্চটার দিকে। পরি সঙ্গে সঙ্গে দেখতে পেল পদ্মপরিটাকে, মঞ্চের ওপরে চিত হয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছে চাঁদটার দিকে। আমার কোলে বসা পরি ভয় ও উত্তেজনায় কাঁপছে। ও মা! পদ্মপরিটা উঠে বসল, পাতার মঞ্চে নাচল কয়েক পাক। শোনা গেল ঘুঙুরের আওয়াজ। তারপরে একটা ফুলের পাপড়িতে দাঁড়িয়ে নাচল আরও কয়েক পাক। তারপরে লাফ দিয়ে শূন্যে উঠে সোনালি ডানায় উড়ল কিছুক্ষণ। তারপরে আবার সেই পাতার মঞ্চটায় এসে শুয়ে পড়ল চিত হয়ে।
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘পরি! ও এখন ঘুমোবে। চল, আমরা ফিরে যাই!’
পরি রাজি হলো। আমি ডোঙার মুখ ঘুরিয়ে রওনা দিলাম।

0 comments:

Post a Comment